Read Time:11 Minute, 4 Second
জেকেরিয়া কুরসুন, ইয়েনি সাফাক:
১২১২ সালের মে মাস। ফ্রেঞ্চ রাজা ফিলিপস সেন্ট ডেনিসে তার সেনাপতিদের সাথে বৈঠক করছিলেন। এমন সময় স্টিফেন অব ওরলিনস নামক এক মেষপালক এসে প্রবেশ করলো। সে ধাপ্পা দিচ্ছিল যে সে জেসাস ক্রাইস্টের বার্তা নিয়ে এসেছে। তাছাড়া সে আলো দাবি করছিল যে সে মেষ পালন করছিল, এমন সময় জেসাস ক্রাইস্ট তার উপর ক্রুসেডারদেরকে উপদেশ দেওয়ার দায়িত্ব আরোপ করেছেন।
গল্পটা বর্ণনা করেছেন রান্সিম্যান, যিনি ক্রুসেডের ইতিহাস গবেষক হিসেবে বেশ নামকরা। কাজেই এটা কোন ফেলনা গল্প নয়।
পাশ্চাত্যের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, “অন্যদের” বিরুদ্ধে শিশুদের উত্তেজিত করে ব্যবহার করার ইতিহাস তাদের অনেক রয়েছে, অথচ তারা কিনা আধুনিক সময়ে এসে নিজেদেরকে সভ্যতার একমাত্র উৎস বলে দাবি করে। সবচেয়ে বেশি জানা ও আলোচিত উদাহরণগুলোর একটি হলো ক্রুসেড যুদ্ধ। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ক্রুসেডগুলোর একটি, যেটি একাদশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা শুরু করেছিলো “জেরুজালেম বাঁচানোর” উদ্দেশ্যে এবং “আনাতোলিয়া থেকে তুর্কিদের হটানোর” উদ্দেশ্যে, সে ক্রুসেডটি হচ্ছে শিশুদের ক্রুসেড, যেটির শুরুর সাথে জড়িত হলো উপরে বর্ণিত গল্পটি।
মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে পরিচালিত চারটি ক্রুসেডের মাধ্যমে ক্রুসেডাররা তাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা মনে করতো, এই ব্যর্থতার কারণ সৈন্যদের মাত্রাতিরিক্ত পাপ, তারা সেটি ইউরোপজুড়ে প্রচার করতে লাগলো, একই সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডাও ছড়াতে লাগলো। তাদের বক্তব্যের মূলকথা ছিল জেরুজালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করা, তাদের বিবেচনায় মুসলমানরা ছিল পাষণ্ড। স্টিফেন মেষ পালনের ফাঁকে এরকম এক প্রচারকের দেখা পান, এবং তার দ্বারা আকৃষ্ট হন। তিনি এতোটাই আকৃষ্ট হন যে তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন যে তার পাপী পূর্বসুরীরা যা অর্জন করতে পারেনি, তিনি তা অর্জন করতে পারবেন। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, তার মধ্যে নিশ্চিতরূপে এই প্রত্যয় জন্ম নেয়, যে তিনিই পারবেন।
স্টিফেন প্রোপাগান্ডা ছড়াতে শুরু করলেন এবং ঘোষণা দিলেন যে তিনিই শিশুদের নিয়ে গঠিত একটি দলকে নিয়ে খৃষ্ট ধর্মকে রক্ষা করতে যাচ্ছেন। শিশুরাও প্রচারকদের দ্বারা সম্মোহিত হয়ে এরকম একটা আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা বিশ্বাস করতে লাগলো, জুন মাস নাগাদ জেসাসের মুজেজার অংশ হিসেবে সমুদ্র শুকিয়ে তাদের জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে। এটা নিছক কোন গালগল্প নয়। ফ্রান্সের ইতিহাসের সমসাময়িক সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, অনুর্ধ্ব ১২ বছর বয়সী প্রায় ৩০,০০০ ছেলে-মেয়ে ভেন্ডমে একত্রিত হয়। তাদের মধ্যে অনেক গ্রামবাসীও ছিল, জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রীরাও ছিল, আর অবশ্যই সেসকল প্রচারকদের অনেকেও ছিল।
শিশু ক্রুসেডাররা সকলে পায়ে হেটে দক্ষিণ দিকে রওনা দিলো। তখন খুবই গরম গ্রীস্মকাল চলছিল, ভ্রমণের জন্য খুবই জঘন্য অবস্থা ছিল। শিশুদেরকে বলা হয়েছিল যে সকল এলাকার পাশ দিয়ে তারা যাবে, সেসব এলাকা থেকে কোন মতে খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে। কিন্তু দেশে চলমান খরা ও দুর্ভিক্ষের দরুণ তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছিল না। তাদের অনেকেই রাস্তায় মারা যায়, এবং তাদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশটি এক বিকেলে শেষ পর্যন্ত মার্সেলে পৌছায়। মার্সেলের লোকজন তাদের প্রতি খুবই উদারতা প্রদর্শন করে এবং নিজেদের ঘর-বাড়ি শিশুদের জন্য খোলে দেয়। পরের দিন সকালে শিশুদেরকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাওয়া হলো মুজেজা দেখানোর জন্য: সমুদ্র শুকিয়ে তাদের জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে! কিন্তু বাস্তবে এমনটি না হওয়াতে তারা বেশ হতাশ হয়ে পড়লো। কিছু বাচ্চারা মনে করলো তারা প্রতারিত হয়েছে এবং স্টিফেনকে দোষারোপ করে তারা দলত্যাগ করলো। অন্যদিকে বিশ্বাসীরা সাগর শুকিয়ে যাওয়ার মুজেজা কখন সংগঠিত হয়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
তখন মার্সেলের দুই ব্যবসায়ী ঘোষণা দিলেন যে তারা ইশ্বরের সন্তুষ্টির জন্যে বাচ্চাদেরকে ফিলিস্তিন পৌছিয়ে দেবেন। স্টিফেন এবং অন্যরা বেশ আনন্দচিত্তে এ প্রস্তাবনা গ্রহণ করলেন এবং জাহাজে চড়লেন। যদিও ঐদিনের পর থেকে তারা আর কখনো শিশুদের কথা শুনে নি। মজার বিষয় হলো স্টিফেনের এই গল্পটি জার্মানিতে বেশ প্রভাব ফেললো। স্টিফেনের পর জার্মান তরুণরাও উদ্যোগ গ্রহণ করলো। এবার নিকোলাস নামে এক তরুণ একই রকম বার্তা দিয়ে শিশু সেনাবাহিনী প্রস্তুত করলো এবং ইতালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এই দলের গড় বয়স আগের দলের তুলনায় বেশি ছিল, মেয়েদের সংখ্যাও এই দলে তুলনামুলক বেশি ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মানি থেকে রওনা দেওয়া ২০,০০০ শিশুর ভাগ্যে একই পরিণতি ছিল। এসকল প্রতারিত শিশুরা কোনদিন জেরুজালেম পৌছতে পারেনি, বাড়িতেও ফিরতে পারেনি। কয়েক জন যাজক ফিরতে সক্ষম হয়েছিলো, ১৮ বছর পর তারা শিশুদের খবর নিয়ে বাড়ি ফিরে ছিলো। খবর অনুযায়ী, মার্সেলে থেকে রওনা দেওয়া জাহাজগুলো পথিমধ্যে ডুবে যায় এবং হাজার হাজার শিশু ডুবে মরে। হাতে গোণা কয়েকটিন জাহাজ ঝড়ের কবল থেকে বেঁচেছিলো, সেগুলো ফিলিস্তিন যায়নি, বরং আফ্রিকার দিকে গিয়েছে। যারা মারা গিয়েছিল, তারা ছিল সত্যিকার অর্থে সৌভাগ্যবান। কারণ যারা আফ্রিকা পর্যন্ত পৌছেছিল, তাদেরকে তাদের স্বধর্মীরা দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়।
বিশ্বের সবচেয়ে নৃশংস ও অর্থহীন যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রুসেড যুদ্ধ, যেটি কিনা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে চলেছিল। এসকল যুদ্ধ শুধু মুসলিম আর তুর্কিদের ক্ষতি করেনি, বরং ইউরোপ ও খৃষ্ট ধর্মেরও বিশাল ক্ষতি করেছিল। নিষ্ঠুরভাবে ক্রসেডের জন্য প্রেরিত অর্ধ লক্ষাধিক শিশু যদি বেঁচে যেতো, কে জানে, হয়তো আজকের পৃথিবী আরো সুখ-শান্তির আবাস হতে পারতো।
তো, সে ইতিহাসের সাথে আমি কেন এখনকার বিষয়গুলোকে সম্পর্কিত মনে করছি?
নিউ জিল্যান্ডে যে ঘাতক ৫০ জন মুসলিমকে হত্যা করেছে, আরো অনেককে আহত করেছে, তার জীভন বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি পাওয়া গেছে, সেটা হলো সে তুরস্কে সফর করেছিল। যদিও আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য নেই, তবু দাবি করা হয়েছে যে সন্ত্রাসীটি নাকি টোকাটের অন্ধকূপেও গিয়েছিল। যেখানটাতে ড্রাকুলাকে রাখা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের ভিলেনের জন্য এটি একটি স্বাভাবিক মনোভাব।
ভালো কথা, ড্রাকুলা কে ছিল? অনেক গল্প-সিনেমার চরিত্র, ড্রাকুলা তৃতীয় ভ্লাদ নামে রোমানিয়াার ওয়ালাশিয়া অঞ্চলের সিংহাসনে আরোহণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে নৃশংসতার জন্যই সে খ্যাত হয়ে আছে। ভ্লাদ, যে ভ্লাদ দ্য ইম্পালার নামেও খ্যাত, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের (মেহমেদ-২ দ্যা কনকুয়েরর) শাসনামলে বেঁচে ছিল। গুজব আছে যে মুহাম্মাদ আল-ফাতিহের নির্দেশে তাকে অন্ধকূপে ফেলা হয়েছিল।
কে জানে, ড্রাকুলার কিংবদন্তিতুল্য চরিত্রই কেন এই সন্ত্রাসীর আদর্শ, কোন কিছু কি চেনা চেনা মনে হচ্ছে?
________________________________
ইয়েনি সাফাক তুরস্কের প্রভাবশালী সরকারপন্থী পত্রিকা। নিবন্ধটি ইয়েনি সাফাকের ইংরেজি সংস্করণে “Child crusaders, Dracula, and the New Zealand mosque shooter” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর কর্তৃক অনূদিত। ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে থেকে সংগৃহীত।